সভ্যতার ক্রমবিকাশে আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নতি হলেও মানসিক উন্নতি আজও থমকে আছে। পদে পদে লাঞ্চনার শিকার হচ্ছে দলিত কমিউনিটি অধ্যুষিত এলাকার মানুষ। সমাজে বৈষম্য যেন পিছু ছাড়ছে না, অস্পৃশ্যতা যেন তাদের আজন্ম পাপ। দলিত, হরিজন বা অন্ত্যজ যে নামেই ডাকা হোক না কেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে তা অভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে তা হচ্ছে এরা অস্পৃশ্য; অচ্ছ্যুৎ, ঘৃণ্য এবং সমাজের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এদের ওঠাবসা নেই। অর্থাৎ সমাজের একশ্রেণীর মানুষ এদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করেই চলেছে। এই লাঞ্চিত-বঞ্চিত এবং দলিত মানুষগুলো হচ্ছে হরিজন, ঋষি, শব্দকর, বেদে, তৈলী, হাজাম, দাই, ধোপা, মানতা, চন্ডাল, মুচী, ডোম, চাড়াল, রবিদাস, রুহীদাস, বেহারা, মেছো কৈর্বত, জলদাস, নিকারী ইত্যাদি।
দলিত এর আভিধানিক অর্থ মর্দিত (পদদলিত), দমিত, শাসিত এবং নিপীড়িত। এরা শোষিত, নির্যাতিত এবং বংশ পরমপরায় বিচ্ছিন্ন। এই জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম পৈতৃক কাজ-কর্মকে প্রাধান্য দিয়ে যুগ যুগ ধরে আঁকড়ে রেখেছে। যুগের পরিবর্তনের সাথে তাদের কোন পরিবর্তন আসছে না। দলিত সম্প্রদায়ের সস্তানেরা অর্থের ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার অভাবে তাদের পৈতৃক পেশায় নিয়োজিত থাকতে বাধ্য হচ্ছে। যার ফলে দলিত সস্তানেরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না এবং উন্নত জীবন যাত্রা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা সত্তেও দলিতদের সন্তানের স্কুলমুখী হওয়ার প্রবণতা অনেকাংশে কম। স্কুলের উপকরণের মূল্য, পোশাকের খরচ, টিউশন ফিস’সহ যাবতীয় খরচ পরিবারের পক্ষে বহন করা কষ্টসাধ্য। একদিকে এই বাড়তি খরচ কমাতে এবং পাশাপাশি পরিবারের জন্য অতিরিক্ত আয়ের আশায় স্কুলগামী সন্তানকে নামিয়ে দিতে বাধ্য হয় শিশুশ্রমে। ফলে বংশ পরম্পরায় তারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর কিছু দলিত শিশু, যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে, তাদের বসতে হচ্ছে পেছনের বেঞ্চে, শুনতে হচ্ছে গাল-মন্দ।
কথা হলো কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ী ইউনিয়নের কাঁস্তা গ্রামের এইচএসসি ১ম বর্ষে পড়ুয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবকের সাথে। তিনি জানান, আমরা দলিত বলে গ্রামের কাছে স্কুল কলেজে পড়তে অনেক অসুবিধায় পড়তে হয়, অন্যরা মুচি-মেথরের বাচ্চা বলে গালি দেয়। আমাদের সাথে কেউ মিশতে-খেলতে চায় না, বন্ধুত্ব করে না, তাই পরিচয় গোপন রেখে দূরের স্কুল কলেজে পড়ি।”
হাতের ঘাঁ-পাচড়া চুলকাতে চুলকাতে বাঁশবাড়িয়া গ্রামের নেতো দাসী বলেন, প্রতিবন্দি ছাওয়াল, ছোট থাকতি বিদবা হইছি। আইজও কোন ভাতার কাড পাইনি। কাড চাইতে গেলে ৩/৪ হাজার টাকা চায়, টাকা যারা দিছে তারা কাড পাইছে। অসুস্থ ছাওয়াল মাঝে মাঝে জুতা সেলাই করে, তাতে সংসার চলে না, তাই আমি মানুষের দুয়ারে চাইতে যাই। তিন বেলা খাইতে পারি না, ছাওয়ালরে ডাক্তর দেখাবো কি দিয়ে”।
বাল্য বিয়ের ভুক্তভোগী বাঁশবাড়িয়া গ্রামের চন্দনা দাস বলেন, জেএসসি ও এসএসসি পরিক্ষায় এ গ্রেড পাইছিলাম, তারপর বিয়ে হয়ে গেল। স্বামীকে অনেক বলেচি কিন্তু পরিবার মত দেয়নি। নিজি নার্স হতি পারিনি, ইচ্ছে আছে, ছেলেডারে অনেক লেখাপড়া করাবো, ডাক্তার বানাবো।”
সমাজে বৈষম্যের কারনে কোন উন্নয়নমূলক কাজে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ হচ্ছে বাধাগ্রস্থ। আজও বাজারে বা স্কুল কলেজে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কোন কমিটিতে রাখা হয় না তাদের। বাজারে দোকান দেওয়াতে বাধা, ওই দোকান থেকে কেনাকাটা করতে নিষেধ করাসহ নানামুখি সমস্যায় পড়তে হয় দলিতদের। এছাড়া জাত পাতের অন্তরকোন্দলের কারনে এই বৈষম্য আরো বেগবান হচ্ছে। আজও পূজোতে প্রতিমা দেখতে হয় দূর থেকে, নিচু জাত বলে মন্দিরে প্রবেশের সীমানা পেরোনো মানে পরের জন্মে কুকুর বিড়াল হয়ে জন্ম নেওয়া। ব্রাক্ষ্মন ঠাকুরদের ছায়া মাড়িয়ে গেলে তো ইহকাল পরকাল সব শেষ। নিজ এলাকায় ছোট মন্দির করলেও জোটেনা পূজারি ও প্রতিমা। এদের কোন ধর্মীয় কাজে আসতে চায় না কোন ব্রাক্ষ্মন পুরোহিত।
দলিতদের মুক্তির আন্দোলন বাংলাদেশ দলিত পরিষদের (বিডিপি) কেশবপুর উপজেলা কমিটির সভাপতি সুজন দাস বলেন, জন্মের পর থেকে আমরা সমাজপতি, উচ্চবর্ণ এবং প্রভাবশালীদের কাছে লাঞ্চিত হচ্ছি। আমাদের দেখার কেউ নেই। লাঞ্চনা-বঞ্চনা আমাদের নিত্য সঙ্গি। সভ্যতার এ যুগেও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল স্থানে আমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি।
বাংলাদেশ দলিত পরিষদ (বিডিপি) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি উদয় দাস জানান, আমরা জন্ম থেকেই জ্বলছি। বৈষম্য মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ‘বৈষম্য নিরোধ আইন’ এখন সময়ের দাবী। স্বাধীন দেশে আজও দলিত শ্রেণীর মানুষ স্বাধীনভাবে চলতে, বলতে বা কোন কাজ করতে পারে না। দেশের দলিত জনগোষ্ঠির মুক্তির একমাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ দলিত পরিষদ। আর তাই দেশের ৫৪টি জেলায় দলিত পরিষদ গঠন করে আমরা দলিতদের অধিকার আদায়ে কাজ করছি।
(267)