রিয়াছাদ আলী, কয়রা (খুলনা): করোনার প্রাদুর্ভাবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলার শ’ শ’ কাঁকড়া খামার বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। করোনার ধাক্কায় কাঁকড়া রফতানি বন্ধ থাকায় বেসামাল হয়ে পড়েছেন বৃহৎ এ অঞ্চলের খামারীরা। খামারগুলো এখন টিকিয়ে রাখায় তাদের জন্য দায় হয়ে দেখা দিয়েছে।
অব্যাহত লোকসানে ইতিমধ্যে ছোট-বড় বেশ কিছু খামার বন্ধ হয়ে গেছে। গত বছরের মার্চ বন্ধ হয়ে যায় চীনে কাঁকড়া রফতানি। পাশাপাশি দেশের বাজারে কমে যায় দাম। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে চলতি বছর আরো অনেক খামারিই কাঁকড়া চাষ বন্ধ করে দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও বর্তমানে অনেক খামারি ব্যাংক ও এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কোনো রকম খামার বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু দেশের বাজারে দাম না পাওয়ায় তা বিক্রি করতে পারছে না।
ফলে দিনের পর দিন বাড়ছে তাদের ঋণের বোঝা। তবে মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ১ হাজার ৬৩ জন কাঁকড়াচাষীকে সহায়তা দেওয়া হবে একটি সুত্রে জানা গেছে। আর খামারিরা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্ত খামারির তুলনায় সরকারের এ সহায়তা নিতান্তই অপ্রতুল। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলায় সরকারি হিসেবে প্রায় দুই সহ¯্রাধীক কাঁকড়া খামার রয়েছে। ওসব খামারের সঙ্গে যুক্ত চাষীর সংখ্যা ৫ সহস্রাধিক। রফতানি বন্ধ থাকায় খামারে চাষ করা অধিকাংশ কাঁকড়াই মরে যাচ্ছে। সেজন্য খামারিদের চরম লোকসানে পড়তে হচ্ছে। সূত্র জানায়, কয়েক বছর ধরেই নানা প্রকার রোগবালাইয়ের কারণে চিংড়ি চাষে তেমন লাভ না হওয়ায় অনেক খামারিই কাঁকড়া চাষে ঝুঁকে পড়ে। তাতে লাভও ভালো হতে থাকে। কিন্তু ২০২০ সালের প্রথম দিকে করোনার থাবায় কাঁকড়া রফতানি বন্ধ হয়ে যায়।
রফতানি বন্ধ ও দাম কমে যাওয়ায় সব খামারের কাঁকড়া সময়মতো বিক্রি করতে পারেনি। এক পর্যায়ে পুকুরেই কাঁকড়া মরে যায়। তবে করোনার প্রকোপ সামান্য কমতে থাকলে গত অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে ধারদেনা করে আবারো অনেক খামারি চাষ শুরু করে। কিন্তু উৎপাদিত কাঁকড়া সরাসরি চীনে না যাওয়ায় অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হয়েছে। ফলে কাঁকড়া বিক্রি করে খামারিদের উৎপাদন খরচও উঠছে না। আর বর্তমানে কাঁকড়া চাষ বন্ধ করেও খামারিরা স্বাভাবিক ঋণের দায়ে ঘরে থাকতে পারছে না।
আর যারা লোকসান টেনেও কাঁকড়া চাষ চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের অবস্থাও বেসামাল। এ অবস্থায় চীনে সরাসরি কাঁকড়া রফতানি চালু করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও বিনা সুদে ঋণ দিয়ে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার দাবি জানিয়েছেন চাষীরা। কয়রা উপজেলার কাঁকড়া ব্যবসায়ী দেবু ঘরামী বলেন, রফতানিযোগ্য কাঁকড়া সাধারণত পাঁচটি গ্রেডে বিক্রয় হয়। বর্তমানে প্রত্যেক গ্রেডের দাম ৩ শ থেকে ৪ শ টাকা কেজিতে কমেছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে ২০০ গ্রাম (ফিমেল) ওজনের কাঁকড়ার কেজি ছিল ১৫ শ থেকে ১৭ শ টাকা, ওই কাঁকড়া বর্তমানে ৮০০ টাকা। ১৮০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ছিল ১ হাজার টাকা, তা বর্তমানে ৬০০ টাকা। ১৫০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ছিল ৮০০ টাকা, এখন তা ৪০০ টাকা। ১০০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া ছিল ৬০০ টাকা কিন্তু বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। এমন দামে কাঁকড়া বিক্রি করে চাষীদের যেমন খরচ ওঠে না, তেমনি ব্যবসায়ীদেরও লোকসানে পড়তে হয়। এদিকে এ প্রসঙ্গে কয়রা উপজেলা কাঁকড়া সরবরাহ সমিতির সদস্য রবি কয়াল জানান, সারা দেশে দুই লক্ষাধিক মানুষ কাঁকড়া চাষ ও ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত।
সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের চাষীদের উৎপাদিত বেশির ভাগ কাঁকড়া বেশি দামে চীনে রফতানি করা হতো। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে রফতানি বন্ধ হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন চাষী ও ব্যবসায়ীরা। করোনাকালে এ অঞ্চলের চাষীদের কয়েক শ’ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। কয়রা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার এস এম আলাউদ্দিন আহমেদ বলেন, এ অঞ্চলের উৎপাদিত কাঁকড়া চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, কোরিয়ায় রফতানি হতো। এর মধ্যে চীনেই রফতানি হয় বেশি অংশ।
চীনে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে কাঁকড়া রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। তাতে চরম বিপাকে পড়েছে চাষীরা। এমন অবস্থায় চাষীদের ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
(16)