মানুষের মনের এই নিরন্তর প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির দ্বন্দ্ব থেকেই সৃষ্টি হয় একের পর এক ঘটনার। কিন্তু এই পাখি হওয়ার বাসনা থেকে কবে যে মানুষ ঘুড়ি উড়াতে শুরু করে তা সঠিক করে বলা মুশকিল। তবে মুশকিল হোক আর যাই হোক, পৃথিবীর প্রতিটি কোনে ঘুড়ি দেখতে পাওয়া যাবে। আমাদের এশিয়া থেকে শুরু করে একেবারে আফ্রিকার আকাশে পর্যন্ত ঘুড়ি দেখতে পাওয়া যাবে। আর এই অলিখিত ঐক্যই হলো গোটা পৃথিবীর মানুষের মানবিক ঐক্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
কিন্তু, প্রশ্ন হলো এই ঘুড়ির আবিষ্কার হলো কোথায়? কে এই সুন্দর উপাদানটির আবিষ্কার করেছিলেন? পাঠক, এই প্রশ্নটির সঠিক উত্তর জানা যায় না, তবে যতটুকু জানা যায় ততটুকু বর্ননা করা যেতে পারে নাটাই-ঘুড়ি আর সুতোকে অবলম্বন করে। শোনা যায়, ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসের ট্যারাস্টাস শহরের আর্কিটাস নামে এক ভদ্রলোক প্রথম ঘুড়ি তৈরি করেছিলেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হান সিন নামে চীন দেশের এক সেনাপতিই প্রথম ঘুড়ি তৈরি করেন। তখন সিল্ক কাপড় দিয়ে ঘুড়ি তৈরি হতো। তবে কাগজ আবিষ্কারের পর থেকেই মূলত কাগজের ঘুড়ি তৈরি শুরু হয়।
ইউরোপ বা আমেরিকায় ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ থাকলেও চীন, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেই এই খেলার জনপ্রিয়তা বেশি। যদিও আকাশ পরিষ্কার থাকলে ও অনুকূল বাতাস পেলেই ঘুড়ি ওড়ানো যায়, তবুও পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই একটি বিশেষ দিনকেই ঘুড়ি দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। এদিন সবচেয়ে বেশি ঘুড়ি আকাশে উড়তে দেখা যায়। সবাই এই বিশেষ দিনটির কথা ভেবেই যেন নিজেদের প্রস্তুত করতে থাকেন। মোটকথা, ঘুড়ি এখন আর শুধু উড়বার বা স্বপ্নের স্বাধীনতার নাম নয়, ঘুড়ি এখন এক উৎসবের নাম।
চীন দেশে ঘুড়ি দিবসের দিন সব বয়সের নারী ও পুরুষ ঘুড়ি উড়িয়ে সেই ঘুড়ির সঙ্গে নিজেদের মনের গোপন কথাটিও উড়িয়ে দেন। বিচিত্র বর্ণের, বিচিত্র আকারের অসংখ্য ঘুড়ি তখন গোটা আকাশ রাঙিয়ে তোলে। ওদেশের ঘুড়িগুলোর রং ও আকার আমাদের দেশের ঘুড়ির চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ। রংবেরংয়ের সুন্দর মাছ, প্রজাপতি, ড্রাগন, পাখি, মানুষ, পরী, জাহাজ ইত্যাদিসহ প্রায় তিন’শ রকমের ঘুড়ি আকাশে উড়তে দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মজার ঘুড়ি হলো লণ্ঠন ঘুড়ি। রাতের বেলায় এই ঘুড়ির মধ্যে লণ্ঠন বসিয়ে ওড়ানো হয়।
আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এরকমই বিভিন্ন ঘুড়ি দিবসে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। আমাদের দেশে প্রতিবছর ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকায় সাকরাইন উৎসবে ঘুড়ি ওড়ানো উৎসব পালিত হয়। তবে এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে সারা দেশে নিয়মিতই চলে ঘুড়ির ওড়াউড়ি। ঢাকায় কিছু সংস্কৃতিসেবী প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর ধরে ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন করে আসছে।
তবে আমরা ঘুড্ডি বলি আর ঘুড়িই বলি, ভারতীয় ঘুড়ির সঙ্গে আমাদের ঘুড্ডির অনেকটা মিল আছে। যদিও ভারতের কিছু প্রদেশে বিচিত্র কিছু ঘুড়ির দেখা মেলে। এসব ঘুড়ির সঙ্গে মালয়েশিয়ার ঘুড়ির কিছু মিল দেখতে পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গে দুইটি কাঠি দিয়ে তৈরি বর্গাকৃতির ঘুড়ি আছে। যার আকারগত কোনো বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায় না। এগুলো নানা রংয়ের কাগজ দিয়ে বিভিন্ন নকশায় তৈরি করা হয়। ডিজাইন মতো এদের বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। যেমন- চাঁদিয়াল, ঢুপিয়াল, ঘয়লা, চৌরঙ্গি ইত্যাদি। ভারতবর্ষের কিছু প্রদেশে ভিন্ন দেশের নেতা বা সিনেমার নায়কদের ছবি ঘুড়িতে লাগিয়ে ওড়ানো হয়ে থাকে।
উপমহাদেশে মুসলিম শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে নানা রকমের ঘুড়ি দেখা গেছে। যেমন- কানকাওয়া, চংগ, তুলকল, পতংগ, গুড্ডি প্রভৃতি। এসব ঘুড়ি তৈরি করা ছিল যেমন শ্রমসাধ্য তেমনি খরচ সাপেক্ষ। দিল্লির রাজা শাহ আলমের আমল থেকেই ঘুড়ি ওড়ানোটা ভারতবর্ষে খেলা হিসেবে মনে করা হয়। নবাবী আমল ছিল পেশাদার ঘুড়ি উড়িয়েদের সুবর্ণ যুগ। তখন ঘুড়ি ওড়ানোর ওপর বাজি ধরা হতো, যা হতো উড়িয়েদের প্রাপ্য।
ঘুড্ডির প্যাঁচ বা কাইট ফাইটিং প্রায় সব দেশেই খেলা হয় কম আর বেশি। তবে এ ব্যাপারে সবচেয়ে মাতামাতি হয় থাইল্যান্ডে। ওখানে ঘুড়ির লীগ প্রতিযোগিতা হয়। সেখানে শীতকালে এ ধরনের প্রতিযোগিতা বেশি দেখা যায়।
ঘুড়ি ওড়ে কিভাবে? ঘুড়িতে সুতো দিয়ে মাটি থেকে নিচের দিকে টান দেওয়া হয়। আর ঘুড়ির ওপর উর্ধ্বমুখী কাজ করে বাতাসের আকর্ষণ শক্তি। এই দুটি টান যতক্ষণ সমান থাকে ততক্ষণ ঘুড়ি আকাশে উড়তে পারে। শুধু খেলার সামগ্রী হিসেবে পরিচিত হলেও অনেক সময়ে এই ঘুড়িই বিজ্ঞানের নানা গবেষণায় সাহায্য করেছে। যেমন- ১৭৪৯ সালে আলেকজান্ডার উইলসন ঘুড়িতে থার্মোমিটার লাগিয়ে ঊর্ধ্বাকাশের তাপমাত্রা নির্ণয়ের চেষ্টা করেছিলেন। ১৯০১ সালের ১২ ডিসেম্বর ঘুড়ির মধ্যে অ্যান্টেনা লাগিয়ে নিউফাউন্ডল্যান্ডের বৈজ্ঞানিক মার্কনি আকাশের ইলেকট্রোম্যাগনেটিভ ওয়েভ ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৭৫২ সালে বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন আকাশে একটি সিল্কের ঘুড়ি উড়িয়ে তার সাহায্যে কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত বিদ্যুৎ ও আকাশের বিদ্যুৎ যে এক তা প্রমাণ করেছিলেন। এছাড়াও যুদ্ধের নানা কাজেও ঘুড়ি ব্যবহার করা হয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। এমনকি প্রেমিকার রাগী বাবার চোখ এড়িয়ে ঘুড়ির গায়ে চিঠি লিখে আকাশের গায়ে পাঠিয়ে দেয়ার ঘটনাও আছে।
-বাহাউদ্দিন আল ইমরান
(52)