নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থী স্বশস্ত্র সংগঠন এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনীর অত্যাচারে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মানুষের জীবন একসময় নাভিশ্বাস হয়ে ওঠে। ফাইভ মার্ডার, ফোর মার্ডার, ট্রিপল মার্ডার, ডবল মার্ডার থেকে শুরু করে খুন, ধর্ষন, চাঁদাবাজী ছিল এলাকায় নিত্যব্যাপার। রক্তাক্ত জনপদ হিসেবে কূখ্যাতি পায় তালা উপজেলা।
প্রশাসনের জোর তৎপরতা, রাজনৈতিক নেতাদের স্বদিচ্ছা এবং সময়ের আবর্তে সেই পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেয়েছিল তালার মানুষ। দীর্ঘবছর ধরে তালার মানুষ শান্তিপূর্ন বসবাস করছে। কিন্তু একটি সন্ত্রাসী চক্রের তৎপরতার কারনে শান্তিপূর্ন এই পরিবেশ দিনদিন ঘোলাটে আকার ধারন করছে। ২ হাজার ৫শত বিঘা আয়তনের ইসলামকাটী চলশের বিল মৎস্য ঘের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দখল চেষ্টাকে কেন্দ্র করে এলাকার মানুষ আতংকিত হয়ে পড়েছে। আর এর প্রভাব ইতোমধ্যে তালা উপশহরসহ আশপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া, সন্ত্রাসীদের তৎপরতায় উক্ত বিল থেকে চলতি বোরো মৌসুমে লক্ষাধিক মন ধান উৎপাদন হুমকির মুখে রয়েছে।
সূত্র জানায়, উপজেলার ইসলামকাটী ইউনিয়নের বারাত, মনহরপুর, কাজীডাঙ্গা, খরাইল, ইসলামকাটী, গণডাঙ্গ ও ভবানীপুরসহ ১০টি গ্রামের প্রায় ২ হাজার ৫শত বিঘা জমি নিয়ে চলশের বিল অবস্থিত। জলাবদ্ধতার কারনে এই বিলে একসময় বোরো আবাদ বন্ধ হয়ে যায়। যেকারনে বিল থেকে পানি নিস্কাশন করে বোরো মৌসুমে ধান চাষের জন্য বিলের জমি মালিকরা ২০১২ সালে ৪ বছর মেয়াদের সাদা মাছের ঘের করার জন্য জনৈক শহিদুল ইসলাম’র সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। এর ১ বছর পর ওই বিলে কেশবপুর উপজেলার সুফলাকাঠি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা মঞ্জুরুল ইসলাম বিধি বহির্ভূতভাবে মাছ চাষ শুরু করে।
এসময়, মঞ্জুরুল চেয়ারম্যানের পোষ্য সন্ত্রাসী জাহিদ এর নেতুৃত্বে একটি বাহিনী বিল এলাকায় বাসবাসকারী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর শারীরিক, মানষিক ও যৌন অত্যাচার, গাছ থেকে ফল লুট, জমি মালিকদের শর্তানুযায়ী হারির টাকা না দেয়া, যথাসময়ে বিল থেকে পানি নিস্কাশন করে কৃষকদের বোরো আবাদ করার সুযোগ করে না দেয়া সহ নানাবিধ অনিয়ম এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সৃষ্টি করে। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে ভুক্তভোগী মানুষ প্রতিবাদমূখর হলে তাদের উপর হামলা চালানো সহ হুমকি দিয়ে দামিয়ে রাখতো মঞ্জুরুলের পোষ্য জাহিদ বাহিনীর সন্ত্রাসীরা।
এবিষয়ে সে সময় সংবাদ পরিবশেন করায় জাতীয় পাক্ষিক নির্ভিক সংবাদ এর সম্পাদক এম. একরামুল হক আসাদকে নানাবিধ হুমকি দেয়া হয়। এমনকি তার উপর একাধিকবার হামলা চালানো সহ তাকে একাধিক হয়রানীমূলক মামলায় আসামী করা হয়। এসব ঘটনায় চলশের বিল আলোচিত হয়ে ওঠে। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এলাকায় আন্দোলন, সংগ্রাম গড়ে ওঠে।
চলতি মাসের ১৮ জানুয়ারী শহিদুল-মঞ্জুরুলের চলশের বিল মৎস্য ঘেরের ডিড’র মেয়াদ শেষ হয়। এরমধ্যে বিলের অধিকাংশ জমি মালিকরা কাংখিত সুবিধা পেয়ে কেশবপুর উপজেলার চুয়াডাঙ্গা গ্রামের সামাদ সরদারের পুত্র, বিশিষ্ট ঘের ব্যাবসায়ী মো. মোস্তাক আহম্মদকে ঘের রেজিষ্ট্রি (দলিল নং : ২০৩, তাং : ১১.০১.১৬) করে দেন।
কিন্তু এরইমধ্যে ওই বিলে মৎস্য ঘের করার জন্য কেশবপুরের ইকবল হোসেন খানও আগ্রহ প্রকাশ করেন। আর বিলে ঘেরকরা জামায়াত নেতা মঞ্জুরুল চেয়ারম্যানও ঘেরের দখল ধরে রাখতে চায়। জমি মালিকরা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে অতিষ্ট হয়ে মঞ্জুরুল চেয়ারম্যানকে ঘের’র রেজিষ্ট্রি ডিড দিতে রাজি না। যে কারনে মঞ্জুরুল কৌশলে তার পোষ্য মহব্বত হোসেনকে সামনে রেখে ঘের দখল নেবার চেষ্টা করছে। এছাড়া ইকবল হোসেন খানও ওই বিলের রেজিষ্ট্রি ডিড নেবার জন্য জমি মালিকদের সাথে দেনদরবার অব্যাহত রেখেছেন। একটি ঘেরের ত্রি-পক্ষীয় দখল চেষ্টার কারনে প্রায় ১ মাস ধরে চলশেল বিল “টক অব দ্যা সাতক্ষীরা”তে পরিনত হয়েছে।
মোস্তাক আহম্মদ জমি মালিকদের কাছ থেকে বিধি মোতাবেক রেজিষ্ট্রি ডিড করার পর ইতোমধ্যে ঘেরে দখল যাবার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। কিন্তু তাতে বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে অবৈধভাবে ঘেরে থাকা মঞ্জুরুল ও তার পোষ্য বাহিনী। গত ১৮ জানুয়ারী ঘেরের ডিড’র মেয়াদ শেষ হবার পর এখনও ঘেরের দখল ছাড়েনি মঞ্জুরুল বাহিনী। এমনকি বিলের শতাধিক বিঘা জমি থেকে শর্তানুযায়ী এখনও পানি সেচ করা হয়নি। যে কারনে এই বিশাল পরিমান জমিতে বোরো চাষ হুমকির মুখে পড়ায় কৃষকরা আতংকিত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া উদ্ভুদ পরিস্থিতির কারনে আগামীতে এই বিলে শান্তিপূর্ন মাছ চাষ না হলে জলাবদ্ধাতার কবলে পড়বে বিশাল আয়তনের বিলটি। এতেকরে একদিকে কোটি কোটি টাকার মাছ চাষ ব্যাহত হবে, অপরদিকে লক্ষাধিক মন বোরো ধান উৎপাদন থেকে কৃষকরা বঞ্চিত হবে।
এদিকে, রেজিষ্ট্রি ডিড নিতে না পেরে মঞ্জুরুল বাহিনী বর্তমানে জমি মালিকদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে ও বাহু শক্তির মাধ্যমে ঘেরের জোর দখল করার চেষ্টা করছে। এমনকি মঞ্জুরুলের পোষ্য সন্ত্রাসী জাহিদ হোসেন বিভিন্ন এলাকার চরমপন্থী ক্যাডারদের সংগঠিত করছেÑ বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এসব চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে মঞ্জুরুল জমি মালিকদের জিম্মি করে ঘেরের নতুন আরও একটি রেজিষ্ট্রি দলিল করার চেষ্টা করছে। গত রোববার মঞ্জুরুল বাহিনী অবৈধ ভাবে ঘের রেজিষ্ট্রির চেষ্টা করলে ইসলামকাটী রেজিষ্ট্রি অফিসে মোস্তাকের পক্ষে জমি মালিকরা অবস্থান গ্রহন করে। এতে এলাকায় আতংক এবং উত্ত্বেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনায় প্রশাসন পুলিশ ও ব্যাটালিয়াান মোতায়েন করে পরিস্থিত নিয়ন্ত্রনে রাখে।
এরপূর্বে বিলের জমি মালিকরা সন্ত্রাসী মঞ্জুরুল বাহিনীর জোরপূর্বক ঘের রেজিষ্ট্রি বন্ধ করার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার, তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ইসলামকাটী সাবরেজিষ্টার সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেন। এই আবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করে, তালা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ কুমার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য তাতে সুপারিশ করেন।
এব্যপারে উক্ত বিলের জমি মালিক অ্যাড. কিসমত আলী, আ.লীগ নেতা ডা. মতিয়ার রহমান, গাজী জামাল উদ্দীন, আমিনুর রহমান, মিজানুর রহমান, মো. আব্দুল মান্নান, আ. গফ্ফার ও সুনীতি মন্ডল সহ একাধিক ব্যক্তি জানান, গত ১৮ জানুয়ারী ঘেরের ডিড শেষ হবর পরও মঞ্জুরুল চেয়ারম্যান জোর করে এখনও উক্ত ঘেরে দখল রয়েছে। কিন্তু জমি মালিকরা তাকে ঘের দিতে রাজি না হওয়ায়, সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে জামায়াত নেতা মঞ্জুুরুল চেয়ারম্যান ঘের দখল করার চেষ্টা করছে। ঘের এলাকায় মঞ্জুরুল চেয়ারম্যানের পোষ্য সন্ত্রাসীদের পদচারনায় এলাকার মানুষ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সহ আইন শৃঙ্খলার অবনতির আশংকা করছে।
এবিষয়ে নির্ভিক সংবাদ সম্পাদক ও উক্ত চলশের বিলের জমি মালিক এম. একরামুল হক আসাদ বলেন, জামাতী শাসনে চলছে তালা। জামায়াত নেতা মঞ্জুরুলের টাকায় তৃপ্ত হয়ে, তাঁর পক্ষে বর্তমান সরকারের একজন মন্ত্রী তালা প্রশাসনকে টেলিফোনিক নির্দেশ প্রদান করেছেন। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে জনৈক কর্নেল ও সিনিয়র সহকারী সচিব। যে কারনে প্রশাসন জামায়াত নেতার পক্ষে কাজ করায়, মঞ্জুরুল চেয়ারম্যানের পোষ্য সন্ত্রাসীরা ঘের এলাকায় প্রকাশ্য মহড়া দিয়ে জোর করে ঘের দখল করার চেষ্টা করছে। তিনি, অবিলম্বে ঘের থেকে সন্ত্রাসীদের উচ্ছেদ করে, আড়াই হাজার বিঘা জমি থেকে কৃষকদের লক্ষাধিক মন ধান ও কোটি কোটি টাকার সাদা মাছ উৎপাদন করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেবার জন্য উর্দ্ধতন প্রশাসনের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
এব্যাপারে তালা উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শেখ নুরুল ইসলাম বলেন, ইসলামকাটী চলশের বিলে ঘের করার জন্য মোস্তাক আহম্মদ বিধি মোতাবেক জমি মালিকদের কাছ থেকে রেজিষ্ট্রি ডিড করে নিয়েছেন। তারপরও অবৈধভাবে মঞ্জুরুল ইসলাম ঘের দখল করার চেষ্টা করছে। এনিয়ে এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। বর্তমানে বৈধ ঘের মালিকের দখল বুঝে দেয়া এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্ন রাখতে উপজেলা প্রশাসনের ভুমিকা দুঃখজনক বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।
-বি. এম. জুলফিকার রায়হান, তালা, সাতক্ষীরা
(7)