পর্দা সরিয়ে বাইরে আসছে মেয়ে

imageসব মিলিয়ে ওঁরা প্রায় জনা পঁচিশ। তার মধ্যে বাইশ বছরের তরুণী আছেন, ষাটোর্ধ্ব প্রৌঢ়াও আছেন। ওঁরা বন্ধু। সকালে হাঁটতে বেরোন একসঙ্গে। সুখে দুঃখে একে অন্যের পাশে থাকেন। আর নিজেদের একসঙ্গে হওয়ার সময়টুকু হাসি-গল্পে ভাগ করে নেন।
শ্যামলী পাঠক সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে এই দলে যোগ দিয়েছেন। অবসর জীবনে যে নতুন করে এত বন্ধু পাবেন, জানতেন না আগে। ইস্কুল-কলেজের পুরনো বন্ধুদের পাশাপাশি এই নতুন বন্ধুরা জীবনে একটা খুশিয়াল মেজাজ এনে দিয়েছে, সে কথা মুক্ত কণ্ঠে বলেন।
শাশ্বতী চৌধুরী পেশায় স্কুলশিক্ষিকা। অল্প কিছু দিন হল অবসর নিয়েছেন। যত দিন চাকরি করেছেন, স্কুলে সহকর্মীরা মিলে হইচই করে কাটিয়েছেন। একসঙ্গে খাওয়া-সিনেমা দেখা ইত্যাদি তো আছেই। প্রতি বছর বেড়াতেও যেতেন ওঁরা। সেই ক’টা দিন স্বামী-সন্তান-সংসার সব কিছু থেকে ছুটি। শুধু নিজেদের আড্ডা, নিজেদের খুনসুটি। অবসরের পরেও সেই বন্ধুত্ব ম্লান হয়নি একটুও।
মেয়েলি বন্ধুত্বের এই জগত নিয়ে শিল্পমাধ্যমে তেমন একটা আলোচনা দেখা যায় না। বন্ধুত্ব শব্দটা আজও অনেকটা যেন পুরুষ-আশ্রিত থেকে গিয়েছে। ‘বন্ধু কী খবর বল’ বা হালের ‘বন্ধু চল’-এর মতো জনপ্রিয় গানের লাইন শুনলে ছেলেদের বন্ধুদের কথাই মনে আসে সকলের। বন্ধুত্বের আইকন বললে কৃষ্ণ-অর্জুন থেকে সুনীল-শক্তি হয়ে জয়-বীরু…। বলিউড তো গত কয়েক বছরে ব্রোমান্সের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। দিল চাহতা হ্যায়, জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা, গুন্ডে, কাই পো চে, রং দে বসন্তী, থ্রি ইডিয়টস…। তালিকা শেষ হতে চায় না।
এর পাশে মেয়েদের বন্ধুত্বের ছবি কোথায়? অণুবীক্ষণ দিয়ে খুঁজতে হতো এত দিন। সম্প্রতি টরন্টো ফিল্মোৎসবে সাড়া ফেলেছে প্যান নালিনের ছবি ‘অ্যাংরি ইন্ডিয়ান গডেসেস’। সাতটি মেয়ের বন্ধুত্বের গল্প। ভারতে মেয়ে-বন্ধুদের নিয়ে তৈরি প্রথম ছবি বলে প্রচার হচ্ছে তার। বাংলা ছবিতে কিন্তু বান্ধবীদের গল্প বলা আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে। ক’দিন আগেই মুক্তি পেয়েছিল ‘আরও একবার’। তারও আগে মৈনাক ভৌমিক ‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস’ বলে একটা ছবি করেছিলেন। কিন্তু ‘আরও একবার’-এর বিশেষত্ব হল, সেখানে বন্ধুত্বের বোধন হয় তিন মধ্যবয়সিনীকে ঘিরে। ভারতীয় ছবি তো বটেই, বিশ্ব সিনেমাতেও বিষয়টা খুব বেশি চর্চিত নয়। ছবিটির কাহিনিভাবনা, সঙ্গীত এবং সৃজনশীল পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন স্মৃতি লালা। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের সমাজে আড্ডা-হইহই-হুল্লোড় মানেই ধরে নেওয়া হয় ছেলেদের জগত, কচিকাঁচাদের জগত। বিশেষ করে বিয়ের পরে মেয়েদের যেন সংসারটাই সব হয়ে ওঠে। অথচ মাঝবয়সে মেয়েরা যে একাকীত্বে ভোগেন, মনের মধ্যে একটা যে খালি জায়গা তৈরি হয়, সেখানে বন্ধুরাই পারে মুক্ত বাতাস বইয়ে দিতে।’’

এক কালে এ দেশেই মেয়েরা কিন্তু শুধু তাদের নিজস্ব বন্ধুত্বটুকু আলাদা করে উদ‌্‌যাপন করবে বলে সই পাতাতো। সেই সব গঙ্গাজল, মৌরীফুল, চোখের বালিদের কথা সাহিত্যের পাতায় লেখা হয়েছে। পুকুরঘাটে, বাড়ির ছাদে, দাওয়ার মাদুরে মেয়েদের কলকলানির টুকরো ছবি ধরা আছে। কিন্তু সে সবই টুকরো। পটভূমি নির্মাণ বা সাবপ্লটের উপাদান মাত্র। আর আছে পার্শ্বচরিত্র, নায়িকার সখি তারা। সে শকুন্তলার প্রিয়ংবদা হতে পারে বা পার্বতীর মনোরমা। পরের দিকে লীলা মজুমদারের লেখায়, দীপক ঘোষালের উপন্যাসে মাঝে মাঝে মেয়ে-বন্ধুদের কথা এসেছে। তবে সামগ্রিক ভাবে, সাহিত্যিক বাণী বসুও মানছেন, মেয়েদের বন্ধুত্বকে অনেক সময়ই মেয়েলি সখিত্বের নাম দিয়ে কিছুটা গুরুত্বহীন করে রাখা হয়েছে। আর ছেলেদের বন্ধুত্ব যেহেতু ঘরের বাইরের ব্যাপার, সেটার দৃশ্যমানতাও অনেক বেশি থেকেছে। বাণীর পর্যবেক্ষণ বলে, মেয়েদের বন্ধুত্বে বহু স্তর। তাঁর মতে, মেয়েদের সবার মধ্যে কমবেশি একটা সুপ্ত লেসবিয়ানিজম থাকে। উৎসব-অনুষ্ঠানে তাই শুধু ছেলেরাই মেয়েদের দেখে না, মেয়েরাও মেয়েদের দেখে।

অথচ বন্ধু শব্দটির গা থেকে পুরুষালি আস্তরণটুকু এর পরেও ঘুচে যায়নি। মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা-ক্রিস এভার্ট বা ওপরা উইনফ্রে-গেল কিংগ বা ঘরের কাছে দূরদর্শনের শাশ্বতী গুহঠাকুরতা-চৈতালি দাশগুপ্তের বন্ধুত্ব নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু দুই বা তিন বান্ধবীর হাসিঠাট্টা-গল্পগাছা-ঝগড়াঝাঁটি নিয়ে যে আস্ত গল্প তৈরি হতে পারে, সেটা সে ভাবে ঘটে ওঠেনি। সোহাগ সেন ‘সোনাটা’ নামে একটা নাটক করতেন। সেখানে তিন পরিণতবয়স্ক বান্ধবীর সম্পর্ক অনেক টানাপড়েন পেরিয়েও টিকে ছিল। নিজের জীবনে এমন অনেক বন্ধুত্বই খুব কাছ থেকে দেখেছেন সোহাগ। বললেন, ‘‘আমার আর রিনার (অপর্ণা সেন) বন্ধুত্বই তো কত যুগ পেরিয়ে গেল!’’

মেয়ে-বন্ধুদের নিয়ে গল্প ভাবার চল এ বার বাড়ে কি না, দেখার সেটাই।

(6)

Print Friendly, PDF & Email

সাম্প্রতিক খবর

Login to your account below

Fill the forms bellow to register

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.