সমাজে অবহেলা আর বঞ্চনা নিয়ে বেঁচে আছে প্রকৃতির খেয়ালে জন্ম নেওয়া উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হিজড়া। এমনকি মমতাময়ী মা তার হিজড়া সন্তানকে লোকলজ্জার ভয়ে একসময় দূরে ঠেলে দিয়েছেন- এমন নজিরও আছে।
বেঁচে থাকার জন্য এখনো হিজড়াদেরকে অন্যের কাছে হাত পাততে হয়। স্বাভাবিক কর্মসংস্থান ও আয় রোজগারের সুযোগ না থাকায় জীবিকার প্রয়োজনে তাদের একটা অংশ ঝুঁকিপূর্ণ যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়। অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের কারণে হিজড়ারা বিভিন্ন রোগ বিশেষ করে এইচআইভি আক্রান্ত হয়। এদের মাধ্যমে এ ভাইরাস অন্যের মধ্যে সংক্রমণ হয়।
বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের দাবির মুখে হিজড়াদের নাগরিকত্ব ও তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তাদের পুনর্বাসনে চাকরিতে নিয়োগ ও আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করে সরকার। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে হিজড়াদের জন্য একটি তহবিল গঠনের ঘোষণা দেয়। চলতি বছর একজন ব্লগারকে হত্যা করে পালানোর সময় এক ঘাতককে ধরে ফেলে লাবন্য নামের এক হিজড়া। এই সাহসিকতার জন্য লাবণ্য দেশজুড়ে প্রশংসা পায়। সেই সঙ্গে দাবি ওঠে হিজড়াদের ট্রাফিক পুলিশে নিয়োগ দেওয়ার। বিভিন্ন সময় মন্ত্রীরা হিজড়াদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আশ্বাস দেন।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যগত উন্নয়নে সরকার ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশের ৭টি জেলায় পাইলট কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ৭২ লাখ ১৭ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল। পরের ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নতুন ১৪টি জেলায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়। এ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল চার কোটি সাত লাখ ৩১ হাজার ৬০০ টাকা।
বর্তমানে ১৪ জেলায় এ কার্যক্রম চলছে। এ কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দ হয় চার কোটি ৫৮ লাখ ৭২ হাজার টাকা। ক্রমান্বয়ে এ কর্মসূচি দেশব্যাপী সম্প্রসারণ করা হবে।
আর্থিক সহায়তার মধ্যে রয়েছে- স্কুলগামী হিজড়া শিক্ষার্থীদের জন্য চার স্তরে (জনপ্রতি মাসিক প্রাথমিক ৩০০, মাধ্যমিক ৪৫০, উচ্চ মাধ্যমিক ৬০০ এবং উচ্চতর ১০০০ টাকা হারে) উপবৃত্তি প্রদান। ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের বিশেষ ভাতা জনপ্রতি মাসিক ৪০০ টাকা প্রদান।
বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম হিজড়া জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয়বর্ধনমূলক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করে তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসা; প্রশিক্ষণোত্তর আর্থিক সহায়তা প্রদান।
এসব কর্মসূচির পরও তাদের জীবনে কোন পরিবর্তন আসেনি। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য আর অপমানের গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় তাদেরকে। হিজড়া সন্তানকে তার পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়। পরিবারের সদস্যরা এদের অবহেলা করে। ধীরে ধীরে এরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সমাজে কেউ এদের ভাল চোখে দেখে না। কোন এলাকায় হিজড়া সন্তান জন্ম নেওয়ার খবর পেলে অন্য হিজড়ারা বিভিন্ন প্রলোভনে তাকে দলে ভেড়ায়। একটা সময় এদের আশ্রয় হয় হিজড়া পল্লীতে। বেঁচে থাকার তাগিদে হিজড়াদের নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়। খালার (হিজড়াদের সর্দার) কড়া শাসনে চলতে হয়। খালার অবাধ্য হলেই কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হয়। দল বেধে পাড়া-মহল্লা, হাট-বাজারে নেচে গেয়ে টাকা তোলে। কেউ টাকা দিতে না চাইলে শরীরের স্পর্শকাতর অংশে হাত দেয়া বা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করার অভিযোগ রয়েছে হিজড়াদের বিরুদ্ধে। তাই এরা কাছে এলে অনেকে মান সম্মানের ভয়ে টাকা দিয়ে দেয়। এদের প্রত্যেককেই নিজের আয়ের একটি অংশ খালার হাতে তুলে দিতে হয়।
স্বাভাবিক কর্মসংস্থান না থাকায় জীবিকার প্রয়োজনে হিজড়াদের একটা অংশ ঝুঁকিপূর্ণ যৌন কর্মে লিপ্ত হয়। সন্ধ্যার পর রাজধানীর বিভিন্ন পার্ক কিংবা নিরিবিলি স্থানে খদ্দেরের অপেক্ষায় থাকে। যৌনরোগে আক্রান্ত হয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে অনেক সময় চিকিৎসা ছাড়াই ফেরত দেয়া হয়।
নাটোরের লালপুর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন হিজরা দোলা। তিনি এখন রাজধানী ঢাকায় থাকেন এবং হিজড়াদের সর্দার অর্থাৎ খালা। তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে কেউ ভালভাবে কথা বলতে চায় না। আমাদের কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। পেটের দায়ে আমাদের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে টাকা তুলতে হয়। আমাদের মধ্যে সামান্য একটা অংশ যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করে। বেঁচে থাকার জন্যই তারা এটা করে থাকে।’ দোলা আরো বলেন, ‘আমাদের জীবন বড় দুর্বিসহ, কোন ভবিষ্যত নেই।’
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকার বাস্তবায়নে সরকার, বেসরকারি সংগঠন ও গণমাধ্যমকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু কর্মসূচি ঘোষণা করলেই হবে না, তার বাস্তবায়ন করতে হবে। হিজড়াদের কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আর বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে তাদের কল্যাণে কাজ করতে হবে। তাহলে সমাজের এই অবহেলিত জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় সম্পদে পরিনত হবে।
–উজ্জল বিশ্বাস, রাইজিংবিডি
(19)