সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়/ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা সে কি ভোলা যায়…।’ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার স্মৃতিগাঁথা সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রাক্তন ছাত্ররা এভাবেই প্রাণের আবেগ আর বাধভাঙা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। প্রাণের টানে মিলেছে সবাই গেয়েছে প্রাণের গান। স্মৃতি রোমন্থন করে বলেছেন-‘মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়, বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়, হায় মাঝে হলো ছাড়াছাড়ি গেলেম কে কোথায়, আবার দেখা যদি হলো সখা প্রাণের মাঝে আয়…।’ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, কেককাটা, স্মৃতিচারণ, সংবর্ধনা, পরিচিতি সভা ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজনের মধ্যদিয়ে সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের হীরক জয়ন্তী পালন করেন প্রাক্তন ছাত্ররা।
শুক্রবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে শুরু হয় উৎসবমূখর পরিবেশ। দেশ-বিদেশ থেকে প্রাণের টানে ছুটে আসেন অনেকেই। বিদ্যালয়ের মাঠ থেকে একটি বিশাল শোভাযাত্রা শুরু হয়ে শহরের আমতলা মোড়, নারিকেলতলা মোড়, খুলনা রোড মোড়, নিউমার্কেট মোড়, পাকাপুল মোড়, কাটিয়া টাউন বাজার মোড় প্রদক্ষিণ করে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ফুটবল ময়দানে শোভাযাত্রা ফিরে এসে শেষ হয়। বেলা ১২টায় শোভাযাত্রা শেষে সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬০ বছর পূর্তির ৬০পাউন্ড কেক কাটা হয়। এরপর সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদানের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের ২৮জন প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক এবং ২১জন প্রাক্তন ছাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়।
সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬০বছর পূর্তি উপলক্ষে বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ সাজানো হয় রংয়ের আবিরে। মাঠের পশ্চিম প্রান্তে প্রায় ৬ ফুট উচ্চতায় বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়। মাঠের দক্ষিণ পাশে নির্মাণ করা হয় নান্দনিক গেট। প্রবেশ পথের মুখে নানা বাণীতে প্ল্যাকাড দিয়ে সাজানো হয়। প্ল্যাকাডে সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে এই যাবৎকাল শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলা বিভিন্ন সংলাপ কোড করে লিখে ওই প্ল্যাকার্ড তৈরি করা হয়।
কয়েকটি নমুনা তুলে ধরা হলো-তুই পেত্তেক দিন দেরি করিস ক্যা? মেরে ব্যাঙ করে দেবো। তুই কিন্তু টার্গেটে আছিস তোর উইকেট পড়ে যাবে। ছেলেরা চক চকি একটা পৃষ্ঠা বের করো। মায়ের ডাকোস ক্যান আল্লাহ’র নাম ল’। তুই চান্দে যা। ভুল সূত্র দিয়ে অংক মিলাও, আইনস্টাইন হইছো? শিক্ষকদের দেওয়া এমন সব সংলাপ প্ল্যাডের মাধ্যমে যেনো দলিল করে রেখেছে প্রাক্তন ছাত্ররা। দুপুরে প্রীতিভোজের পর শুরু হয় স্মৃতিচারণ। একই মঞ্চে ৬০বর্ষ উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক প্রাক্তন ছাত্র সংগঠনের আহবায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুজ্জামান খোকনের সভাপতিত্বে গুণীজন ও কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা জানানো করা হয়। সন্ধ্যায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
এসময় উপস্থিত ছিলেন আয়োজনকারী সংগঠনের সদস্য সচিব কামরুজ্জামান রাসেলসাতক্ষীরা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আসাদুজ্জামান বাবু, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সজীব খান, সাবেক জেলা শিক্ষা অফিসার কিশোরি মোহন সরকার, প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক হাবিবুল হুসাইন, সাবেক প্রধান শিক্ষক নুর মোহাম্মদ, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল মাজেদ, বর্তমান প্রধান শিক্ষক সমরেশ কুমার দাশ, প্রাক্তন ছাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান আলমগীর, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. সুশান্ত ঘোষ, ডা. হরষিত চক্রবর্তী, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রাক্তন ছাত্র সাহাদাৎ হোসেন, জোনায়েদ হোসেন লস্কর বায়রন, ফারুকুজ্জামান ডেভিড, পৌর কাউন্সিলর কায়ছারুজ্জামান হিমেল, সাবেক পৌর কাউন্সিলর মাসুম বিল্লাহ শাহিন, মীর তাজুল ইসলাম রিপন, তানজিম কালাম তমাল, দেবাশীষ সেখর বসুসহ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন মেধাবী ছাত্ররা। সমগ্র অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন প্রাক্তন ছাত্র সিভিল সার্জন খুলনার ডা: মেহেদী নেওয়াজ।
সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সবুজ মাঠে একত্র হয়েছিলেন প্রায় ৩২ শ’ নানা বয়সী সাবেক শিক্ষার্থী। বাবা-ছেলে, দাদা-দাতি, যুবক-বৃদ্ধ মিলেমিশে একাকার। এযেন নবীন-প্রবীনের মিলনমেলা। তাঁরাও মেতেছিলেন বিদ্যালয়টির ৬০বর্ষ পূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে।
৬০বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠের চারপাশ বর্ণিল সাজে সজ্জিত হয়। সকাল ৯টায় জাতীয় সংগীতের পর জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এরপর বেলুন ও ফেস্টুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা। অনুষ্ঠানে বক্তারা শৈশব-কৈশোরের নানা স্মৃতিচারণা করেন।
১৯৬২ সালে সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবার পর ১৯৬৮ সালে জাতীয়করণ হয়। ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল সাতক্ষীরায় হানাদার বাহিনী প্রবেশ করে ২১ এপ্রিল পাকি সেনারা সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রিত শরণার্থীদের মধ্য থেকে অধিকাংশকে পার্শ্ববর্তী দীনেশ কর্মকারের বাড়িতে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগাঁখা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক এ বিদ্যালয়টি ৬০বছর ধরে আলোকিত মানুষ গড়ার কাজ করছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিভাগে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছেন অনেকেই। বক্তারা বিদ্যালয়টির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করেন।
(1)