পানি সম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সম্প্রতি তার মন্ত্রণালয়ে বলেছেন, কপোতাক্ষ নদ কেনো, যেকোনো প্রকল্পের কাজে আর্থিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হবে। কপোতাক্ষ খননে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়ে থাকলে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সরকার।
মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রকল্পের কাজে স্বচ্ছতা আনয়নের জন্য কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু, সেটি রহস্যজনক কারণে বাস্তবায়ন হয়নি। এ বিষয়ে মন্ত্রীর রহস্যজনক ভূমিকায় এলাকার ভুক্তভোগী জনগণ, পরিবেশবিদসহ সমাজ সচেতন মানুষ আরো হতাশ হয়ে পড়েছেন।
জানা গেছে, ২৬২ কোটি টাকার চার বছর মেয়াদী এ খনন-প্রকল্পে শুরু থেকে যে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছিল দিন দিন তা এখন আরো জোরালো হচ্ছে। প্রতিবাদে ইতোমধ্যে ফুঁসে উঠেছে উপকূলীয় জনপদের ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ। এসব দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাট বন্ধে ‘কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন সমন্বয় কমিটি’, ‘সীমানা নির্ধারণ ও দুর্নীতিমুক্ত কপোতাক্ষ খনন বাস্তবায়ন কমিটি’সহ বিভিন্ন সংগঠন কিছুদিন আগে তালায় এক যৌথ গণসমাবেশ করেছে।
তাদের অভিযোগ, খনন কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রকল্পের মূল লক্ষ্য বিশেষ করে নদের নাব্যতা ফিরিয়ে জলাবদ্ধতা নিরসন তো হবেই না, বরং উল্টো বিস্তীর্ণ জনপদজুড়ে দেখা দেবে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। এতে পানিতে যাবে প্রকল্পের সমুদয় অর্থ ২৬২ কোটি টাকা। আর পকেট ভারি হবে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও পাউবোর এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের।
প্রসঙ্গত, কপোতাক্ষ নদ খননে ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকার চার বছর মেয়াদি প্রকল্পটি ২০১১ সালের জুলাই মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন হয়। প্রকল্পের শর্ত অনুযায়ী, প্রথম দফায় ১৯ হাজার ৪৫০ মিটার মাটি খননের জন্য ১৫টি গ্রুপে ১২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয় পাউবো। এছাড়া স্থানীয় দু’জন ইউপি চেয়ারম্যানকে ৮৫৫ মিটার ও চারজন ইউপি সদস্যকে ৯৪৫ মিটার খননের কার্যাদেশ দেয়া হয়। চলতি বছরেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ঠিকাদারদের অসৎ উদ্দেশ্য ও শম্ভুক গতির কারণে কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে আরো এক বছর। এই এক বছরেরও ৪ মাস ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। বাকি ৮ মাসে বাস্তবে আর কতটুকু কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
কারণ, প্রকল্পের নির্ধারিত মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেলেও খনন কাজের অগ্রগতি অত্যন্ত সামান্যই। বেসরকারি একটি সংস্থার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন মতে, এ পর্যন্ত সর্বসাকুল্যে ২০ ভাগ কাজও সম্পন্ন হয়নি। কিন্তু প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে ৯৯ কোটি ৯৫ লাখ (৩৮.১৬%) টাকা ছাড় করা হয়েছে। অর্থাৎ ছাড় করা অর্থের প্রায় অর্ধেকই ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় পাখিমারা বিলে টিআরএম (জোয়ার-ভাটার ব্যবস্থাপনা) চালুর জন্য প্রস্তুতিমূলক কাজ প্রায় সম্পন্ন দেখানো হলেও তার ন্যূনতমও বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি সেখানকার ১ হাজার ৫৬২ একর জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা থাকলেও গত দুটি অর্থবছরে (২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫) তাদেরকে মাত্র ১ কোটি ৭৪ লাখ ৩ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে; যা অতি নগণ্য বলে ক্ষতিগ্রস্থ জমির মালিকরা জানিয়েছেন।
পাউবো সূত্র জানায়, ২০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য কপোতাক্ষ নদ ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার তাহেরপুর থেকে উৎপত্তি হয়ে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, যশোরের ঝিকরগাছা, কেশবপুর ও মনিরামপুর, সাতক্ষীরার তালা, কলারোয়া, আশাশুনি ও শ্যামনগর এবং খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কাশিমনগরের ওপর দিয়ে শিববাড়ি শিবসা নদীর ত্রিমোহনায় মিশেছে। প্রকল্পের অধীনে সাতক্ষীরার তালা, যশোরের কেশবপুর ও খুলনার পাইকগাছা অংশে কাজ চলছে (বর্তমানে বন্ধ)। ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ অংশের ২১ দশমিক ২৫০ কিলোমিটার খননে ৬১ কোটি ৮০ লাখ ৭৪ হাজার ৬০০ টাকা ব্যয় বরাদ্দ হয়।
এর আগে যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছিল, তাদের প্রকল্পটির কার্যক্রম ২০১৫ সালের ৩০ জুনের মধ্যে সম্পন্ন করতে আদেশ দেয়া হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ২০১১-১২ অর্থবছরে ২৮ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১১৪ কোটি ৬৫ লাখ ৭৯ হাজার, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১০২ কোটি ৬৩ লাখ ২৬ হাজার এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৫ কোটি ৮৮ লাখ ১৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। শর্তানুযায়ী খননকৃত মাটি মূল নদের সীমানার ২০০ ফুট দূরত্বে ফেলার কথা থাকলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা অনৈতিক ও খামখেয়ালিভাবে খনন কাজ পরিচালনা করায় স্কেভেটর দিয়ে নদী খনন করে তা ভরাটকৃত নদীর মধ্যেই ফেলা হয়েছে। যাতে করে খননকৃত নদীর গভীরতা বেশি বলে চালিয়ে দিতে ঠিকাদারদের সুবিধা হয়। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম দিকে পাইকগাছা অংশে যে কাজ হয়েছিল তার সফলতাও ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে। কেননা, অতিবৃষ্টি ও উজানের পানির চাপ বৃদ্ধি পেলেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের কাজ ফেলে চলে যায়। এতে নদীর মধ্যে ফেলে রাখা মাটি পানিতে ধুয়ে আবারও খননকৃত নদেই গিয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র তাদের নানাবিধ দূর্নীতির পাশাপাশি কাজের মন্থরগতির কারণেই মূলত সরকারের ওই কোটি কোটি টাকা গচ্চা গেল। এছাড়া বিস্তীর্ণ জনপদ অতিরিক্ত পানির চাপ সহ্য করতে না পেরে তার উগ্রে দেওয়া পানি এবং জনপদের বৃষ্টির পানি নিষ্কাশিত হতে না পেরে দুয়ে মিলে উপকুলীয় এলাকায় জলাবদ্ধতা স্থায়ীরূপ নিয়েছে। ভেসে গেছে বহু ফসলের ক্ষেত, মাছের ঘের, পানের বরজ, ধ্বসে পড়েছে বহু কাঁচা ঘরবাড়ি। অনেকে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে ওয়াপদার বাঁধ ও সরকারি রাস্তায়।
সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনের সংসদ সদস্য ও কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন সমন্বয় কমিটির প্রধান এডভোকেট মুস্তফা লুৎফুল্লাহ এ ব্যাপারে এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, কপোতাক্ষ নদ খননে শুরু থেকেই লুটপাট চলছে। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকায় দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে ব্যাপক লেখালেখি হলে সম্প্রতি যশোরে পানিসম্পদ মন্ত্রীর উপস্থিতিতে একটি তদারকি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু, অদৃশ্য কারণে সে কমিটি আর গঠিত হয়নি। ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ড ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে তাদের ইচ্ছেমতো অপকর্ম করে যাচ্ছে।
ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির এই সংসদ সদস্য অভিযোগ করে আরো বলেন, এসব প্রকল্পে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ‘গাইড লাইন্স অব পার্টিসিপেটরি ওয়ার্টার ম্যানেজমেন্ট’ নীতিমালা সঠিকভাবে অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। তবে পাউবো তাদের দুর্নীতি জায়েজ করতে কতিপয় চিহ্নিত জনপ্রতিনিধিকে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করে জনগণের অংশগ্রহণের চিত্র দেখিয়েছে। যা মূলত দুর্নীতিকেই সহায়তা করছে বলে মুস্তফা লুৎফুল্লাহ অভিমত ব্যক্ত করেন।
এ প্রসঙ্গে বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অখিল কুমার বিশ্বাস বলেন, আগে খনন কাজে কি হয়েছে তা তার জানা নেই। তবে তার যোগদানের পর থেকে কপোতাক্ষ খননে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না বলে তিনি দাবি করেন। যদিও তার দাবির সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই।
প্রসঙ্গত, একযুগ আগে যশোর-সাতক্ষীরা অঞ্চলের জলাবদ্ধতা শুধুমাত্র বিল-খালের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে কপোতাক্ষের নাব্যতা মারাত্মক হ্রাসের পাশাপাশি বৃষ্টির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বসতি এলাকা, কৃষিজমি ও মৎস্যঘেরসহ বিস্তীর্ণ জনপদ জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে। এভাবে বছরের প্রায় ছয় মাস জলমগ্ন থাকায় এই উপকূলীয় জনপদের প্রায় ৫০ লাখ মানুষের জীবন চরম দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। এছাড়া শিক্ষা, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়াসহ যোগাযোগ অবকাঠামোসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছে। সব মিলিয়ে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে এ অঞ্চলের অর্থনীতি।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, শুধু খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরাবাসীর জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্যই কপোতাক্ষ নদ হচ্ছে না; দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে সম্ভাব্য পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা এবং এই বিস্তীর্ণ জনপদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের স্বার্থেই কপোতাক্ষকে আবারো খর¯্রােতা করে তোলা অপরিহার্য। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজে ব্যাপক অনিয়ম হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলা উচিত বলে প্রকৌশলী ইনামুল হক অভিমত ব্যক্ত করেন।-শীর্ষ কাগজ
(20)